একুশে সিলেট ডেস্ক
এক সময় জৈন্তা রাজ্য ছিল। ১৭ পরগনার অধিভুক্ত এলাকা। ভারত উপমহাদেশে বৃটিশরা শাসন করার একশ’ বছর পর জৈন্তা রাজ্য স্বাধীন করতে পেরেছিল। তবে; আগের পরগনা প্রথা এখনো চালু আছে। জৈন্তার ১৭ পরগনা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি সালিশ কমিটি। জৈন্তা রাজ্য বলতে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের একাংশ ছিল। দেশ স্বাধীনের পর সেই সীমানা বিভক্ত হয়। এখন জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসন। এই আসনের ৬ বারের এমপি ইমরান আহমদ। পূর্বের জৈন্তা রাজ্যের এখন দুই তৃতীয়াংশ এলাকার এমপি ছিলেন তিনি। ৮৬’ থেকে এ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়ে আসছেন ইমরান আহমদ। ৬ বারের এমপি হওয়ায় এ আসনের ‘অঘোষিত রাজা’ ছিলেন তিনি। বিএনপিতে প্রার্থীরা এসেছেন, চলেও গেছেন কিন্তু ইমরান আহমদ তার অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সিলেট-৪ তার বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগের ভেতরে কাউকেই তিনি গড়ে উঠতে দেননি। নানাভাবে দমিয়ে রেখেছেন।
ফলে নৌকার টিকিট সব সময়ই তিনি পেতেন। পতিত শেখ হাসিনার পারিবারিক ঘনিষ্ঠজন ছিলেন ইমরান আহমদ। ধানমণ্ডির ৩২-এ পাশের বাসা ছিল তার শশুরবাড়ি। সেই সূত্র ধরে ইমরান নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোটে প্রার্থী হলেও ইমরান আহমদ সব সময় এ আসনের মানুষদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলতেন। মানুষদের দেখলে কখনো গাড়ি থেকে নামতেন, আবার কখনো নামতেন না। হাত মেলাতেন লোক দেখে দেখে। জমিদারি জমিদারি ভাব নিয়ে চলতেন তিনি। কিন্তু তার এই স্বভাব পরিবর্তন হয়েছিল দুই হাজার সালের পূর্বে যখন এ আসনে বিএনপি’র নেতা হয়ে মাঠে নেমেছিলেন দিলদার হোসেন সেলিম। প্রয়াত এ নেতা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলায় তখন কিছুটা সামাজিক হতে শুরু করেন ইমরান আহমদ। বাড়ি জৈন্তাপুরের শ্রীপুর পাথর কোয়ারির তীরে। ফলে এই কোয়ারিতে তার ঘনিষ্ঠজনেরাই এক দুই তিন দশক ধরে লুটপাট চালাচ্ছেন। আর কোয়ারির পাথর লুটের বেশির ভাগ টাকাই গেছে ইমরান আহমদের পকেটে। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মন্ত্রী থাকার সময় ২৪ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। গত ৩রা সেপ্টেম্বর ইমরান আহমদসহ ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা হয়েছে।
ট্রাভেল ব্যবসায়ী আলতাব খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন। সেই মামলায় রোববার রাতে ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ইমরান আহমদ। ৫ই আগস্টের পর এলাকার সংঘটিত হওয়া একাধিক ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায়ও তিনি ছিলেন ফেরারি আসামি। এদিকে ইমরান আহমদ গত সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণী দিয়েছিলেন সেখানেও দেখা গেছে তার সম্পদ ২০০৮ সালের হলফনামায় দেয়া বিবরণের প্রায় ৭০ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ২০১৮ সালে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৭ টাকা এবং পরের নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা। কিন্তু হলফনামায় দেয়া তথ্যের সঙ্গে অনেক গড়মিল রয়েছে। নিজ এলাকা এবং মন্ত্রী হওয়ার পর অবাধে লুটপাট চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও হলফনামার তথ্য ছিল হাস্যকর, এমনটি জানিয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকার লোকজন। তারা জানান, ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছানাকান্দি পাথর কোয়ারি এবং স্থানীয় নদীগুলোতে বালু লুট হতো ইমরান আহমদের কথায়। তিনি যখন বলতেন বন্ধ, তখন সব বন্ধ হয়ে যেতো। আর লুটপাটের সিংহভাগ টাকা স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের মাধ্যমে তার কাছে ঢাকায় যেতো। আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ইমরান আহমদ নির্বাচনী ব্যয় কখনো তার পকেট থেকে করতেন না। লুটপাটের একাংশের টাকা দিয়েই প্রতি ৫ বছর পরপর নির্বাচনে ব্যয় করতেন।
বার বার এমপি নির্বাচিত হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতেন না। যারা প্রতিবাদ করতেন তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। শ্রীপুর চা বাগান ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সেই বাগান মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও তিনি বৈধতা না নিয়েই বাগান পরিচালনা করতেন। তিন থানায় ইমরান আহমদের ছিল লুটপাট নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব বাহিনী। একদিকে যেমন বালু ও পাথর লুট করা হতো অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্তকে চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো তারই ঘনিষ্ঠ সাঙ্গপাঙ্গরা। শুধু ইমরান আহমদই নয়, তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে অনেকেই হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। জৈন্তাপুরে ইমরানের মূল মানুষ ছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এম লিয়াকত আলী। অনেক আগে থেকেই লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ঝুলছে। গোয়াইনঘাটে ছিলেন অধ্যক্ষ ফজলুল হক। আর কোম্পানীগঞ্জে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়া। এর মধ্যে শনিবার রাতে র্যাবের হাতে আপ্তাব আলী কালা মিয়া গ্রেপ্তার হয়েছে। নতুন করে ইমরানের সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য হেনা বেগম। তখনকার এমপি’র প্রধান সেনাপতি হিসেবে তারা পরিচিত ছিল। অভিযোগ উঠেছে- তিন উপজেলা থেকে প্রতি বছর পাথর, বালু লুট ও চোরাচালান বাবদ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। লুটের নায়ক ছিলেন ইমরান আহমদ। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর এখন তার সহযোগীদের কেউ এলাকায় নেই। তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন।
Leave a Reply